সৌমিত্র সেন
একটা বছর। সময় হিসেবে খুব দীর্ঘ নয় হয়তো। কিন্তু বাঙালির কাছে বড় কমও নয়। কারণ, এক বছর হল বাঙালি হারিয়েছে তার অন্যতম 'কালচারাল আইকন'কে (Cultural Icon)। তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (Soumitra Chatterjee)। আজ, এই ১৫ নভেম্বরই তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী।
সৌমিত্রের মৃত্যুতে কি বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে একটা পাহাড়ই শুধু সরে গেল? তা নয়। আর, তা নয় বলেই বাঙালির চিত্তে বড় বেদনার মতো বেজেছে তাঁর মৃত্যু। ফিল্মের নায়কের পাশাপাশি তিনি তো চরিত্রাভিনেতা, নাট্যাভিনেতা, নাট্যকার, বাচিকশিল্পী, কবি, গদ্যকার, সম্পাদক, চিত্রশিল্পীও। সৃজনশীল কর্ম ও মননের ক্ষেত্রে বহুতলীয় অস্তিত্ব তাঁর, বহুমাত্রিক দ্যুতি তাঁর। হয়তো আক্ষরিক অর্থেই সৌমিত্র ছিলেন উনিশ শতকীয় রেনেসাঁসের এক অন্তিম সত্তা, যাঁর মধ্যে অন্তত সেই আকাশটা ছিল যেখানে নানা ভাবনার নানা চিন্তার, নানা প্রণোদনার, নানা কর্মোচ্ছলতার অঢেল রঙের বন্যাস্রোত বওয়ানোর একটা ইচ্ছে অন্তত বইত। শুধু রুপোলি পর্দাতেই যা সীমায়িত নয়।
অথচ, সব চেয়ে বড় ফ্যালাসিটা হল সৌমিত্রকে সদা-সর্বদা সিনেমা দিয়েই বিচার করা হয়। নায়ক সৌমিত্র তথা অভিনেতা সৌমিত্রই বাকি সব সৌমিত্রকে আপাদমাথা ঢেকে দিয়েছে। তিনি উত্তমের শ্রেষ্ঠ প্রতিদ্বন্দ্বী তথা প্রতিস্পর্ধী কিনা, তিনিই উত্তম-উত্তর যুগের শ্রেষ্ঠ নায়ক কিনা, সত্যজিতের ছবিতে তিনি যতটা উজ্জ্বল ততটা অন্যদের ছবিতেও কিনা-- এই সব কূট তর্কে ও বিতর্কে বাঙালিচিত্ত যতটা 'অ্যাবসর্বড', ততটা তাঁর জীবনানন্দের কবিতাপাঠ, 'এক্ষণ' বা মঞ্চাভিনয়-পর্ব নিয়ে নয়।
আসলে সৌমিত্রের মধ্যে একটা অন্তহীন তৃষ্ণা ছিল। ভাল কিছু করার জন্য। সেই 'ভাল'টা মঞ্চে, পর্দায়, লেখনে, বাচনে সর্বত্র সযত্নে অনুশীলিত হতে চাইত, হতও। সেই ভালর সাধনায় নিমগ্ন হতে-হতে তিনি ক্রমশ একটা পারফেকশনের চূড়ান্তে পৌঁছতে চাইতেন। তার নানা নজির। আজীবন শুধু ভাল জটিল কঠিন চরিত্রে অভিনয় করার তাঁর যে লোভ, তা সম্ভবত একটা দৃষ্টান্তবিশেষ।
আরও পড়ুন: Children's Day 2021: ঋতুপর্ণা, প্রসেনজিৎ থেকে স্বস্তিকা, টলিউডের তারকাদের ছোটবেলার অদেখা ছবি
আর শেখা এবং শিখে নিয়ে নিজেকে পাল্টে ফেলা? তা-ও আছে। তখন তপন সিনহার সঙ্গে একটি ছবি করছেন তিনি। অভিনয়ক্ষমতার চূড়ান্তে অবস্থিত বাংলা ভিন্নধারার ছবির অবিসংবাদী মুখ সৌমিত্র সেই ছবির কাজ করতে গিয়ে তখন আশ্চর্য হওয়ার এক্সপ্রেশন নিয়েও নতুন করে শিখলেন এবং ভাবলেন। 'ইগো' তাঁকে সেই কাজ থেকে বিরত করতেই পারত। করল না, কারণ, সৌমিত্র আজীবন পিপাসার্ত। ওই ছবিতে সিচুয়েশনটা ছিল-- সৌমিত্র অভিনীত চরিত্রটি মাথা নীচু করে কিছু লিখছে, এই অবস্থায় বিস্ময়ের কোনও কারণ ঘটেছে এবং বিস্মিত হয়ে সে মুখ তুলছে। বিস্ময়ের অভিব্যক্তি প্রকাশে পোড়-খাওয়া সৌমিত্র ঝটিতি মাথা তুলে ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন দিলেন; কিন্তু পরিচালকমশায় সেই দুরন্ত অভিনেতাটিকেও এক্সপ্রেশনের অন্য রাস্তা দেখালেন। বললেন, 'আচ্ছা, সৌমিত্র, দ্রুত মুখ না তুলে ধীরে ধীরে মাথা তুলেও তো বিস্ময় প্রকাশ করা যায়'? ব্যস! চিরশিক্ষার্থী সৌমিত্র লুফে নিলেন সেই পরামর্শ। পরবর্তী সময়ে তিনিই শুটিং চলাকালে পরিচালকের সঙ্গে তাঁর এহেন বাক্যালাপের ঝাঁপি উপুড় করেছিলেন।
এমন একটা আশ্চর্য মন বাঙালি হারিয়েছে। যে-মন 'ইগো'কে বিসর্জন দিয়ে 'আত্ম'কে বড় করে তোলে। যে-মন নিছক একজন নায়ক বা একজন অভিনেতা বা একজন কবি বা একজন নাট্যকারের চেয়ে অনেক অনেক বড়। তাই এই ১৫ নভেম্বর বাঙালির বড় দুঃখের দিন।