জি ২৪ ঘণ্টা ডিজিটাল ব্যুরো: ‘অপারেশন সিঁদুর’ (Operation Sindoor) যে ব্যাপক ভাবে সাফল্য পেয়েছে এবং এই অভিযান যে পাকিস্তানকে (Pakistan) বড় রকমের শিক্ষা দিয়েছে, আবার সেই কথাই শোনা গেল স্থলসেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদীর (Upendra Dwivedi) কণ্ঠে। বায়ুসেনা প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল (Air Chief Marshal) অমরপ্রীত সিংহ শনিবারই জানিয়েছিলেন, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ পাকিস্তানের ছ’টি যুদ্ধবিমান (Jet flighter) ধ্বংস করেছে ভারত। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে স্থলসেনাপ্রধানের কণ্ঠে শোনা গেল ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সাফল্যের কাহিনি। শুধু তা-ই নয়, কী ভাবে রণনীতি তৈরি করা হয়েছিল, কতটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, কী ভাবে শত্রুপক্ষকে মাত করতে সক্ষম হয়েছে, সবই তুলে ধরেছেন আইআইটি মাদ্রাজের একটি অনুষ্ঠানে। তিনি এই অভিযানকে 'ধূসর অঞ্চলের' (grey zone) যুদ্ধক্ষেত্রে একটি উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ 'দাবা খেলা' (Chess) হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ভারতের বায়ুসেনা প্রধান এয়ার চিফ মার্শালের বক্তব্য:
শনিবার আইআইটি মাদ্রাজ-এ ইন্ডিয়ান আর্মি রিসার্চ সেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে দ্বিবেদী ব্যাখ্যা করেন যে, এই অপারেশনটি প্রচলিত যুদ্ধের তুলনায় কম তীব্র হলেও এটি ছিল অত্যন্ত সুচিন্তিত এবং সুপরিকল্পিত ছিল, যা পাকিস্তানকে চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্যই তৈরি করা হয়েছিল।
অপারেশন সিঁদুর ছিল একটা দাবার বোর্ড:
তিনি বলেন, 'অপারেশন সিঁদুর'-এ আমরা দাবা খেলেছিলাম। আমরা জানতাম না শত্রুর পরবর্তী চাল কী হবে এবং আমরা কী করতে যাচ্ছি। একেই ধূসর অঞ্চল বলা হয়।' তিনি আরও বলেন, 'কোথাও আমরা তাদের চেকমেট দিচ্ছিলাম এবং কোথাও আমরা নিজেদের ক্ষতির ঝুঁকি নিয়েও তাদের শেষ করে দিচ্ছিলাম, কিন্তু এটাই সামরিক জীবনের আসল চ্যালেঞ্জ।' অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে পুরো শক্তি প্রয়োগ না করে শত্রপক্ষকে ঘায়েল করার একটা রণকৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল। যা অনেকটা দাবা খেলার মতোই। যেখানে বিপরীতে থাকা খেলোয়াড়ের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে তা নিয়ে কোনও রকম আগাম বার্তা থাকে না। এত ঝুঁকির মধ্যেও শত্রুপক্ষকে (পাকিস্তান) বাজিমাত করতে দেওয়া হয়নি। বরং নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শত্রুপক্ষের উপর হামলা চালানো হয়েছে।
'Victory is in the mind— জয় আসলে মানসিকতায়, এভাবেই পাকিস্তানের প্রচারযুদ্ধের কৌশল ব্যাখ্যা করলেন সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী (Army Chief)।
নিখুঁত কৌশল:
অপারেশন সিঁদুরে ভারতও কৌশল নিয়েছিল নিজের মতো, সোশ্যাল মিডিয়া ও বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বার্তা পৌঁছে দেওয়া। 'আমাদের প্রথম বার্তা ছিল—Justice Done। এই বার্তা বিশ্বজুড়ে সর্বাধিক মানুষের কাছে পৌঁছেছিল,' জানান দ্বিবেদী। দুই মহিলা অফিসারের নেতৃত্বে সেনা ও বায়ুসেনার যৌথ সাংবাদিক বৈঠক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল ও এক জুনিয়র কমিশন্ড অফিসারের তৈরি লোগো—সবই ছিল পরিকল্পিত কৌশলগত প্রচারের অংশ।
তিনি জানান, এই গোয়েন্দা-তথ্যভিত্তিক অভিযানে ছিল নয়া রণকৌশল। দাবার খেলায় যেমন প্রতিপক্ষের চাল বোঝা যায় না, তেমনই ছিল সিঁদুর অভিযান।
ভারতের রাজনৈতিক সদিচ্ছা:
রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়েও প্রশংসা করেন তিনি। পহেলগাম গণহত্যার পরদিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং তিন বাহিনীর প্রধানদের ডেকে বলেন, “Enough is enough'। দ্বিবেদী বলেন, 'আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল সিদ্ধান্ত নেওয়ার। এই আস্থা ও রাজনৈতিক স্পষ্টতা মনোবল বাড়িয়ে দেয়'।
উল্লেখ্য, ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পহেলগামে পাকিস্তান-ঘনিষ্ঠ জঙ্গিরা পর্যটকদের উপর হামলা চালিয়ে ২৬ জনকে হত্যা করে। তার প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তান ও পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ন’টি জঙ্গি ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে একশোরও বেশি জঙ্গিকে খতম করে। গত মাসে অপারেশন মহাদেব-এ ধরা পড়ে তিন অভিযুক্ত জঙ্গি।
পাকিস্তানের পাগলের প্রলাপ:
পাকিস্তানকেও খোঁচা দিতে ছাড়েননি স্থলসেনাপ্রধান। তাঁর কথায়, 'এই গোটা অভিযানে একটা বিষয়ের বড় ভূমিকা ছিল। তা হল ন্যারেটিভ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম। অর্থাৎ, মন থেকে যেটা ভেবে নেওয়া হয়, সেটাকেই ঠিক বলে মেনে নেওয়া।’ স্থলসেনাপ্রধানের মতে, পাকিস্তানও সেই কৌশল অবলম্বন করেছে। তারা মনে মনে ভেবেই নিয়েছে যে জয় তাদের হয়েছে। যদি কোনও পাকিস্তানিকে জিজ্ঞাসা করা হয় আপনারা জিতেছেন না হেরেছেন, তা হলে ওঁরা বলবেন, 'আমাদের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত হয়েছেন। অতএব আমরাই জিতেছি।' আর এটাই হচ্ছে ‘মাইন্ড গেম’। যা মনের মধ্যে এমন একটা ধারনা চারিয়ে দেওয়ার কৌশল, যা কখনও ঘটেইনি। পাকিস্তানও সেই কৌশল নিয়েছে বলে মত স্থলসেনাপ্রধানের।
ভারতের অভিযানগত কৌশল:
স্থলসেনাপ্রধান আরও জানিয়েছেন যে, কী ভাবে তিন সেনাকে এই অভিযান চালানোর জন্য পুরোপুরি ছাড় দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘২৩ এপ্রিল তিন সেনাপ্রধানের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বৈঠক হয়। এই প্রথম বার দেখলাম যে, প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলছেন, অনেক হয়েছে আর নয়। আর সেটাই ছিল সেনার মনোবল বাড়ানোর পক্ষে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি বার্তা।’’ স্থলসেনাপ্রধান জানিয়েছেন, তিন সেনাপ্রধানকে বলা হয়েছিল, রণনীতি আপনারাই তৈরি করুন। আর সেই বার্তাই ছিল অত্যন্ত ভরসার। তাঁর কথায়, ‘এই বার্তা পাওয়ার পরই ২৫ এপ্রিল নর্দার্ন কমান্ডে পৌঁছোই আমারা। সেখানে রণনীতি বানানো হয়। কোন পথে, কী ভাবে অভিযান চালানো হবে, তা একটি ধারণা তৈরি করা হয়। তার পরই ৯ মে সাতটি ঘাঁটিতে হামলা চালানো হয়। যে হামলায় অনেক জঙ্গির মৃত্যু হয়েছে।'
কেন অভিযানের নাম ‘অপারেশন সিঁদুর’ দেওয়া হয়েছে, সেই ব্যাখ্যাও দিয়েছেন স্থলসেনাপ্রধান। তিনি জানিয়েছেন, ছোট নাম, কিন্তু অভিযানের এই নামই গোটা দেশকে জুড়েছে। দেশবাসীর মধ্যে একটা শক্তির সঞ্চার করেছে। ‘সিঁদুর’ শব্দটার মধ্যে এতটাই ক্ষমতা।
প্রসঙ্গত, গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে জঙ্গিরা হামলা চালায়। সেই হামলায় মৃত্যু হয় ২৬ জনের। তার পরই গত ৯ মে পাক ভূখণ্ডে অপারেশন সিঁদুর সামরিক অভিযান চালায় ভারত। সেই ঘটনায় দু’দেশের মধ্যে সাময়িক সামরিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছিল।
(দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির টাটকা খবর, আপডেট এবং ভিডিয়ো পেতে ডাউনলোড-লাইক-ফলো-সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের App, Facebook, Whatsapp Channel, X (Twitter), Youtube, Instagram পেজ-চ্যানেল)