সৌমিত্র সেন: ভারত খুব আশ্চর্য এক দেশ। নানা তার পরত, নানা তার অভিমুখ। হালে যে-দেশে সমলিঙ্গ প্রেম বা বিবাহকে বৈধ-স্বীকৃত-আইনত করার জন্য এত ভাবনা, এত চর্চা, এত লড়াই-- প্রাচীন ভারতে তা ছিল খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার! তর্কের খাতিরে 'খুব স্বাভাবিক' না হলেও, অন্তত আকাশ-থেকে-পড়া বিজাতীয় ভাবনা ছিল না তা, বলাই যায়! এবং এটা এই কারণেই আরও চমকপ্রদ যে, যে-বিষয়টিকে আমরা ইদানীং 'হালের' বলে দাগিয়ে দিচ্ছি, 'আধুনিক', কখনও-কখনও 'অত্যাধুনিক' 'সোশ্যাল আসপেক্ট' বলেও মনে করছি, কী অবলীলায় তা প্রাচীন ভারতে হাজার-হাজার বছর আগেই অনুশীলিত হত!
কী ভাবে বলা সম্ভব হচ্ছে কথাটা? সম্ভব হচ্ছে, কারণ সেই নিদর্শন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বেদে, পুরাণে, ভারতীয় মহাকাব্যে, ভারতীয় শাস্ত্রে। শাস্ত্রে প্রায়শই তৃতীয় লিঙ্গের (বা 'তৃতীয় প্রকৃতি'র) উল্লেখ মেলে। স্মৃতিতে বা সংহিতায় 'মহিলা চরিত্রের পুরুষ' বা 'পুরুষ চরিত্রের মহিলা'রও উল্লেখ মেলে। কামসূত্রে ক্লীবলিঙ্গকেও মান্যতা দেওয়া হয়েছে! এবং শুধু তাই নয়, সেখানে পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে-- ক্লীবলিঙ্গেরও দ্বৈত সত্তা থাকে! ভাবনার দিক থেকে যুগান্তকারী নয়?
এরকম যুগান্তকারী ইঙ্গিত-সংকেত-রূপক-প্রতীক এদেশের প্রাচীন সমাজচিন্তার ক্ষেত্রে আরও-আরও রয়েছে। যেমন মিত্র-বরুণ। বেদে মিত্র আর বরুণের অন্তরঙ্গতার কাহিনি রয়েছে। এঁদের দু'জনের অযোনিসম্ভূত এক সন্তানের কথাও জানা যায়। বরুণের বীর্য বল্মীক স্তূপের উপর পড়লে বাল্মীকির জন্ম হয়। ওদিকে উর্বশীকে দেখে মিত্র এবং বরুণের বীর্যস্খলিত হলে এবং স্খলিত হয়ে তা জলে পড়লে তা থেকে যথাক্রমে অগস্ত্য আর বশিষ্ঠের জন্মের কথাও জানা যায়।
যেমন অগ্নি। জানা যায়, অগ্নি অন্য দেবতার বীর্য গ্রহণ করেন। এদিকে তিনি স্বাহার স্বামী, আবার সোম বা চাঁদের সঙ্গে রমণ করেন। 'রমণ' বিষয়টি এখানে অবশ্য একটু আলাদা। অগ্নি স্বর্গে বসেই তাঁর মুখ দিয়ে, বলা ভালো তাঁর লেলিহান শিখা-রূপ জিহ্বা দিয়ে, পৃথিবীর সমস্ত উৎসর্গ-নিবেদন গ্রহণ করেন, পান করেন। হিন্দু শাস্ত্র এর ব্যাখ্যায় বলে, মুখ দিয়ে চেটে নেওয়ার এই ভঙ্গিমাটি আসলে অন্যতম মিথুনভঙ্গিমা, যেখানে অগ্নির মুখ যোনির কাজ করে!
ওদিকে শিবপুরাণে রয়েছে, শিব যখন পার্বতীর সঙ্গে দুরন্ত উদ্দাম সঙ্গমে রত হন, তখন দেবতাদের মনে শঙ্কা জাগে। অনন্ত কাল ধরে চলা এই সঙ্গমে বিশ্বে তো প্রলয় ঘটে যাবে! কী হবে? বিশ্বকে রক্ষা করতে হবে তো? কে তাঁদের এই ভয়ংকর সুন্দর মিলনকে বন্ধ করবে? সমস্ত দেবতা তখন একজোট হয়ে শিব-পার্বতীর মিলনে বাধা দেন। বিরক্ত-রাগান্বিত শিব তাঁর অ-স্খলিত বীর্য কোনও দেবতাকে ধারণ করার নির্দেশ দেন। তখন অগ্নি সেই শিব-বীর্য পান করেন। আমাদের প্রতিপাদ্য, এখানে এক পুরুষ অন্য পুরুষের নিঃসৃতবীর্য পান করছেন! সেই সময়ের নিরিখে এ কি খুব সহজ-সাধারণ বিষয়? মৎস্যপুরাণে আছে, বিষ্ণু একবার 'মোহিনী' নামে সুন্দরী রমণীর রূপ ধারণ করেন। তাঁকে দেখে প্রেমে পড়ে যান শিব। উভয়ের মিলনও হয়। সেই পুরুষ-মিলন থেকে জন্ম নেন লর্ড আয়াপ্পা। কেরলের শবরীমালা মন্দিরে যিনি অধিষ্ঠিত।
এই পুরুষ-পুরুষের মতো নারী-নারী দৃষ্টান্তও রয়েছে। গণেশজন্মের মধ্যেই আছে সেই ইঙ্গিত। তেরো শতকের কাশ্মীরী পুঁথি জয়দ্রথের 'হরচরিতাচিন্তামণি'তে আছেও সেই ঘটনা। পার্বতী তাঁর রজঃ নদীজলে ধুচ্ছিলেন। সেই জল পার্বতীর সহচরী (এই সখী হাতি-মাথা) মালিনী খেয়ে ফেলেন। এর ফলে মালিনীর ঔরসে হাতিমাথা গণেশের জন্ম হয়। অর্থাৎ, গণেশজন্মের পুরো ব্যাপারটাই নারীসংসর্গের ফল!
কৃত্তিবাস রামায়ণে আছে, সূর্যবংশের অন্যতম প্রধান রাজা দিলীপের মৃত্যু হলে তাঁর দুই রাণীকে (যাঁরা ঘটনাচক্রে তখন বিধবা) শিব পরস্পরের সঙ্গে উপগত হওয়ার নির্দেশ দেন। তাই ঘটে। এবং তাঁদের সেই 'মিলনে' হাড়হীন এক শিশুর জন্ম হয়। পরে অষ্টাবক্র মুনির বরে সেই শিশুটি পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে ওঠেন। এঁরই নাম হয় ভগীরথ, যাঁকে আমরা সকলে চিনি।
আরও এক মহাকাব্যিক চরিত্রকে আমরা ভীষণ রকম চিনি। তিনি হলে মহাভারতের শিখণ্ডী। তিনি ভারতের আবহমান লিঙ্গধারণাকে ভেঙে ফেলার মূর্ত প্রতীক। দ্রুপদরাজের কন্যা হিসেবে জন্মগ্রহণ করেও শিখণ্ডী বেড়ে ওঠেন একজন পুরুষ হিসেবেই। কুরুক্ষেত্রযুদ্ধে ভীষ্মের মৃত্যুর জন্য তাঁকে দায়ী করা হয়। কেননা, ভীষ্ম তাঁকে 'নারী'ই মনে করতেন, 'পুরুষ' নন, আর ভীষ্ম নারীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেন না!
প্রাচীন ভারতের শিল্পকলা ও স্থাপত্যও সমপ্রেমের নানা সাক্ষ্য মেলে। ৯৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১০৫০ খ্রিস্টাব্দের সময়-পর্বে নির্মিত খাজুরাহো মন্দিরের গায়ে সমপ্রেমী নারীপুরুষের মধ্যে অবাধ যৌনতার ছবি দেখা গিয়েছে। নারীমূর্তি ও পুরুষমূর্তি পরস্পরকে ঘনিষ্ঠভাবে আলিঙ্গন করে রয়েছে-- এমন মিথুনমূর্তি প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্যের অন্যতম অভিজ্ঞান। বৌদ্ধ ও হিন্দুধর্মকে ভিত্তি করে তৈরি অজন্তার গুহাচিত্রে এবং ইলোরার স্থাপত্যেও এ-জাতীয় সমপ্রেমের ও সমপ্রণয়ের নানা অনুষঙ্গ!
ফলে, আজকের এই ভারত, একুশ শতকের ভারত, পৃথিবীর অন্যতম উন্নয়নশীল দেশ ভারত, এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী দেশ ভারত তার সামাজিক ক্ষেত্রে যা ভাবছে, যা হওয়া বা না-হওয়া উচিত বলে মনে করছে, তার কত অনুষঙ্গ, কত দৃষ্টান্ত একটু অন্য রূপে ও রূপকে ছড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন ভারতে পরতে-পরতে, ভাবলে সত্যিই আশ্চর্য না হয়ে উপায় থাকে না!
(দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির টাটকা খবর, আপডেট এবং ভিডিয়ো পেতে ডাউনলোড-লাইক-ফলো-সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের App, Facebook, Whatsapp Channel, X (Twitter), Youtube, Instagram পেজ-চ্যানেল)